স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা - NCTB BOOK

স্বাস্থ্য কী অর্থাৎ স্বাস্থ্য বলতে আমরা কী বুঝি তা প্রথমে জানা দরকার। সাধারণত আমরা স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক সুস্থতা বা শরীরের নীরোগ অবস্থাকে বুঝি। কিন্তু ব্যাপক অর্থে কেবলমাত্র শারীরিক সুস্থতাই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, শরীরের সাথে মনের সুস্থতাও প্রয়োজন। অতএব দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্থতাকে পরিপূর্ণ সুস্থ বলা যায়। বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্য রক্ষা এবং শরীরের বৃদ্ধির জন্য মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন। তবে এই খাদ্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও সুষম হতে হবে। যে সকল খাদ্য শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে সেগুলো পুষ্টিকর খাদ্য। সুষম খাদ্য সেই সকল খাদ্যের সমাহার যাতে সকল খাদ্য উপাদান যথাযথ অনুপাতে ও পরিমাণে থাকে। সুষম খাদ্য শরীরে পুষ্টি যোগায় ।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-

  • পুষ্টির ধারণা ও শিক্ষার্থীদের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • পুষ্টিহীনতার ধারণা ও এর প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব ।
  • ক্রীড়াক্ষেত্রে পুষ্টিহীনতার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • খেলোয়াড়দের জন্য পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • বয়স ভেদে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্যতালিকা তৈরি করতে পারব।
  • খাদ্যে বিষক্রিয়া প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।

 


 

Content added || updated By

যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে

খোলাস্থানে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখলে

অধিক তাপে রান্না করলে

অপরিচ্ছন্ন স্থানে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখলে

পাঠ-১ : পুষ্টির ধারণা ও এর প্রয়োজনীয়তা :

বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের দৈহিক বৃদ্ধি অত্যন্ত দ্রুত হয়। শারীরিক এই বৃদ্ধিকে সহায়তা করার জন্য পুষ্টির প্রয়োজন। শরীরে শক্তি যোগানো, ক্ষয়পূরণ ও রোগ প্রতিরোধের জন্য বাড়ন্ত বয়সে সকল উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্যসামগ্রী যথাযথ পরিমাণে গ্রহণ করতে হয়। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য না খেলে শরীর ও মনের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় বয়ঃসন্ধিকালে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা, দৌড় ঝাঁপ, খেলাধুলা প্রভৃতি নিয়ে মেতে থাকে। শারীরিক পরিশ্রমের কারণে তাদের বেশি ক্যালরি বা খাদ্যশক্তির প্রয়োজন হয়। পুষ্টিমান কম এমন খাদ্য গ্রহণ করলে দেহের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়

খাদ্য উপাদান : খাদ্যে মোট ৬টি উপাদান আছে। এগুলো হলো প্রোটিন বা আমিষ, কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, ফ্যাট বা স্নেহ, ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ, মিনারেল বা খনিজ পদার্থ এবং পানি। যে খাদ্যে যে উপাদান আছে সেই খাদ্য সেই উপাদানের নামে পরিচিত। যেমন যে খাদ্যে আমিষ আছে তা আমিষ জাতীয় খাদ্য, যাতে শর্করা আছে তা শর্করা জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি।

খাদ্য উপাদানের উৎস ও এর গুণাগুণ : খাদ্যের আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় উপাদান দেহ গঠন করে, দেহের বৃদ্ধিসাধন ও ক্ষয়পূরণ করে। আমিষ জাতীয় খাদ্য দেহে কর্মশক্তি যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, পনির, ছানা, সব রকম ডাল, শিমজাতীয় সবজির বীজ ইত্যাদিতে আমিষ পাওয়া যায়। শর্করা ও শ্বেতসার প্রধানত তাপ ও কর্মশক্তি যোগায়। চাল, গম, ভুট্টা, আলু, চিনি, মধু, ওল, মিষ্টি ইত্যাদি শ্বেতসার ও শর্করাজাতীয় খাদ্য। চর্বি বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য দেহে তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে। মাখন, ঘি, চর্বি, সয়াবিন, সরিষার তেল, দুধ, মাছের তেল, নারিকেল তেল ইত্যাদিতে স্নেহ বা ফ্যাট রয়েছে। দেহের রোগ প্রতিরোধ করা ও দেহের ভিতরে বিভিন্ন কাজকর্ম সচল রাখা, দেহকে রক্ষা করা ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণের কাজ। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মাছের তেল, সবুজ ও লাল রঙের শাক-সবজি, ফল, সব রকমের ডাল, তেলবীজ, ঢেকি ছাঁটা চাল, ভুসিযুক্ত আটা, অঙ্কুরিত বীজ প্রভৃতি ভিটামিনসমৃদ্ধ খাদ্য। দেহের অভ্যন্তরীণ গঠনের কাজ সম্পাদনের জন্য খনিজ পদার্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেহে লোহা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি খনিজ পদার্থ থাকে এবং তা প্রতিদিন মলমূত্র এবং ঘামের সাথে বেরিয়ে গিয়ে শরীরের ক্ষয় সাধন করে। এ ক্ষয় পূরণের জন্য খনিজ লবণ পাওয়া যায় এমন খাদ্য যেমন লবণ, দুধ, দুধজাত খাদ্য, ছোট মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, নানা রকম ডাল, শাক-সবজি, লেবু, কলা, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হয়। দেহের শতকরা ৭০ ভাগ পানি। পানি দেহের গঠন বজায় রাখে ও দেহকে ঠান্ডা ও সচল রাখে, খাদ্য হজমে সাহায্য করে, রক্ত চলাচলে ও দেহের অভ্যন্তরে পুষ্টি পরিবহন এবং দেহের বর্জ্য নিঃসরণে সহায়তা করে। শরীর রক্ষা ও বদ্ধির জন্য যথাসময়ে সুষম খাদ্য পরিমাণমতো গ্রহণ করা প্রয়োজন। উপরে উল্লিখিত খাদ্য উপাদানসমূহ যে সকল খাদ্যে যথাযথ অনুপাতে ও পরিমাণে থাকে তাই সুষম খাদ্য। বিভিন্ন বয়সে সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিন্ন হয়। একটি শিশুর জন্য যতটুকু আমিষ, শর্করা ও অন্যান্য উপাদান সংবলিত খাদ্য প্রয়োজন, একজন কিশোর বা কিশোরীর প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। অতএব বয়স, লিঙ্গ, দৈহিক কাঠামো অনুযায়ী এই সুষম খাদ্যের চাহিদারও ভিন্নতা হবে।

 

 

কাজ-১ : নিচের ছকে কলাম-১ ও কলাম-২ তে যথাক্রমে খাদ্যের নাম এবং তা দেহের কোন কাজে লাগে তা এলোমেলোভাবে দেওয়া আছে।

প্রতিটি খাদ্য দেহের যে কাজে লাগে তীর চিহ্ন দিয়ে তার সাথে মিলাও।

 

                 কলাম-১

                 খাদ্য

                                            কলাম – ২

                           প্রধানত দেহের যে কাজে লাগে

  • চাল
  • রঙিন শাক-সবজি
  •  আয়োডিনযুক্ত লবণ
  • কচু শাক
  • মাংস ও ডিম
  • পানি
  • মাখন
  • সব রকমের ফল
  • রোগ প্রতিরোধ করে
  • দেহের খনিজ পদার্থের চাহিদা পূরণ করে
  • রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে
  • দেহের গঠন ও বৃদ্ধি সাধন করে
  • রক্ত চলাচলে সাহায্য করে
  • দেহকে ঠান্ডা ও সচল রাখে
  • দেহের ক্ষয়পূরণ করে
  • দেহের বর্জ্য নিঃসরণে সাহায্য করে
  • তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে





 

 

Content added || updated By

পাঠ-২ : পুষ্টিহীনতার কারণ ও প্রতিকার :

বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্যরক্ষা এবং শরীরের বৃদ্ধির জন্য মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য দেহের পুষ্টিসাধন করে। সুন্দর স্বাস্থ্য, সুস্থ মন, কাজে উৎসাহ ও পরিশ্রম করার প্রবণতা সুপুষ্টির লক্ষণ। পরিশ্রম করার জন্য শক্তির দরকার। পুষ্টিকর খাদ্য মানুষের পরিশ্রম করার জন্য শক্তির যোগান দেয়। খাদ্যের ছয়টি পুষ্টি উপাদান দেহে এসব কাজ করে দেহের পুষ্টি সাধন করে।খাদ্য উপাদানের কাজ : খাদ্য উপাদানের কাজের ভিন্নতা রয়েছে। এসব উপাদান দেহের গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, তাপ ও কর্মশক্তি সরবরাহ, তাপ ও শক্তি উৎপাদন, দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও সচল রাখা, রক্ত চলাচল, পুষ্টি পরিবহন, দেহবর্জ্য অপসারণ, দেহ শীতলীকরণ প্রভৃতি বহুমাত্রিক কাজ করে।

সুষম খাদ্য ও চাহিদা : খাদ্যের ৬টি উপাদান যখন আদর্শ অনুপাতে গ্রহণ করা যায়, সেই খাবারকে সুষম খাদ্য বলে। তবে বয়স ও লিঙ্গ ভেদে দৈহিক কাঠামো অনুযায়ী সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ও চাহিদাও ভিন্ন হয়। যেমন একটি শিশুর জন্য যতটুকু আমিষ, শর্করা ও অন্যান্য উপাদান সংবলিত খাদ্য প্রয়োজন, একজন কিশোর বা কিশোরীর প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি। আবার একজন শ্রমিক বা খেলোয়াড়ের খাদ্যের পরিমাণ তার থেকে আরও বেশি হবে।

পুষ্টিহীনতার ফলে সৃষ্ট রোগ : শিশুর খাদ্যে আমিষের পরিমাণ কম হলে মাংসপেশি গড়ে উঠার বদলে ক্ষয় পেতে থাকে। শরীরে পানি আসে, ফুলে যায় ও শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ রোগের নাম কোয়াশিওরকর । আমিষ, শর্করা, চর্বি প্রভৃতি পুষ্টির অভাবে শিশু মেরাসমাস রোগে আক্রান্ত হয়। এটা শিশুর আমিষ ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালরির অভাবজনিত রোগ। লৌহ, আমিষ ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রক্তের রক্তকণিকা তৈরি করে। খাদ্যে এ সব উপাদানের ঘাটতি থাকলে রক্তস্বল্পতা বা এনিমিয়া হয়। খাদ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ডি'র অভাব হলে শিশুর রিকেটস রোগ হয়। আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড হয়। ভিটামিনে এ'র অভাব হলে রাতে দেখতে অসুবিধা হয়। থিয়ামিনের অভাবে বেরিবেরি রোগ, রিবোফ্লাবিনের অভাবে ঠোটে, জিহ্বায় ও মুখে ঘা, ভিটামিন সি'র অভাবে স্কার্ভি প্রভৃতি রোগের সৃষ্টি হয়।

পুষ্টিহীনতার কারণ : পুষ্টিহীনতার প্রধান কারণ অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। পরিবারের বাড়ন্ত শিশুদের চাহিদা বাদ দিয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের মাছের মাথা, দুধের সর, পনির, মাছ বা মাংসের বড় টুকরা পরিবেশন করা মারাত্মক ভুল। বয়স্ক লোকের যেমন আমিষ ও চর্বির চাহিদা কম হয় তেমনি এর বিপরীতে বাড়ন্ত শিশু, কিশোর-কিশোরীদের চাহিদা হয় অনেক বেশি। খাদ্য পরিবেশনে ভুল নীতির দরুণ পুষ্টিহীনতা খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

পুষ্টিহীনতার প্রতিকার

১। দামি খাদ্যের পরিবর্তে একই পুষ্টিমান ও উপাদানসমৃদ্ধ কম মূল্যের খাদ্য নির্বাচন করতে হবে।

২। খাদ্য সম্পর্কে কুসংস্কার বা ভ্রান্ত ধারণা যেমন হাঁসের ডিম, বোয়াল মাছ, গজার মাছ, খাওয়া যাবে না, এরূপ ধারণা পরিহার করতে হবে। মিষ্টি কুমড়া প্রভৃতি

৩। বাবা-মাকে পুষ্টিমানযুক্ত খাবারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে হবে।

৪। অধিক সময় ধরে রান্না করলে অনেক শাক-সবজির খাদ্যগুণ নষ্ট হয় তা বাবা-মাকে জানাতে হবে।

৫। শাক-সবজি রান্নার আগে ধুয়ে নিতে হবে। কাটার পর ধোয়া চলবে না ।

৬। আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গাভী পালনের জন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৭। বড় মাছের দাম বেশি বলে এগুলোর পরিবর্তে ছোট মাছ খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

৮। খাদ্য উপাদান অনুসারে একটি তালিকা তৈরি করে সেখান থেকে দৈনন্দিন খাদ্য বাছাই করে পরিবারে

যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৯। পুষ্টি, পুষ্টিহীনতা, প্রতিকার প্রভৃতি বিষয়ে রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

কাজ-১ : তোমাদের এলাকায় যে সব খাদ্য স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় সে সকল খাদ্যের নাম দিয়ে একটি সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি কর।

কাজ-২ : পুষ্টিহীনতার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কয়েকটি উদাহরণ ধারাবাহিকভাবে বোর্ডে লেখ এবং দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা কর।


 

Content added || updated By

পাঠ-৩ : বয়স অনুসারে খেলোয়াড়দের খাদ্য তালিকা ও ক্যালরির চাহিদা :

খাদ্য দেহের পুষ্টি সাধন করে। সুন্দর স্বাস্থ্য, সতেজ মন, কাজে উৎসাহ ও পরিশ্রম করার প্রবণতা সুপুষ্টির লক্ষণ। পরিশ্রম করার জন্য শক্তির দরকার। যে কোনো হাতিয়ার যেমন- দা, কুড়াল, ছুরি দিয়ে কাজ করলে এক সময় সেগুলো ভোঁতা হয়ে যায়, কাঠ ব্যবহারের ফলে ক্ষয় হয়, জুতা পুরনো হলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু হাতের আঙ্গুল দিয়ে অনবরত কাজ করা হলে কিংবা পা দিয়ে হাঁটা বা অন্য কাজ করা হলে তা ক্ষয় হয়ে যায় না। কারণ খাদ্য দেহের ক্ষয়পূরণ করে, পরিশ্রম করার শক্তি দেয়। মোট কথা খাদ্য দেহযন্ত্রকে সচল ও কর্মক্ষম রাখে। খাদ্যের ছয়টি পুষ্টি উপাদান দেহে এসব কাজ করে দেহের পুষ্টি সাধন করে। ছয়টি খাদ্য উপাদান যথা আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, অজৈব লবণ, ভিটামিন ও পানি যথাযথ অনুপাতে যে খাদ্যে পাওয়া যায় তাকে সুষম খাদ্য বলে। সুষম খাদ্যের এসব উপাদানের কাজ বিভিন্ন প্রকারের। বয়স, দেহের ওজন এবং পরিশ্রমের তারতম্য অনুসারে  স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি বিভিন্ন ব্যক্তির খাদ্য চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন শৈশবে সর্বাধিক আমিষের দরকার। শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় এমন ব্যক্তির তাপ উৎপাদনকারী খাদ্যের প্রয়োজন। সন্তানসম্ভবা এবং প্রসূতি মায়ের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা সাধারণ স্ত্রীলোকের চেয়ে বেশি। আবার রোগ ভোগের পর পুষ্টির চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থা অপেক্ষা বেশি থাকে। একজন খেলোয়াড় খেলাধুলা করার জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করে বলে তার খাদ্য চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে।

শক্তিও ক্যালরির পরিমাণ : আমিষ, শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাক হওয়ার পর দেহে তাপ উৎপন্ন করে। খাদ্য হতে উৎপন্ন তাপ মেপে খাদ্যের ক্যালরির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। খাদ্যের ক্যালরি মূল্য কিলোক্যালরিতে প্রকাশ করা হয়। যেমন- ২৫০ গ্রাম দুধ থেকে ১৬৫ কিলোক্যালরি এবং এক চা চামচ চিনি থেকে ১৬ কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন হয়। খাদ্যে নিহিত তাপ দেহযন্ত্রকে সচল রাখে, শরীরে কাজ করতে শক্তি যোগায়। খেলাধুলা করার জন্য, দৌড়ানো, রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালানো, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ প্রভৃতিতে বেশি শক্তি ব্যয় হয়। শরীরের ওজন বেশি হলেও কাজে বেশি শক্তি ব্যয় হয়। দেহের প্রয়োজনীয় শক্তিকে তাপের আকারে এবং কিলোক্যালরির হিসাবে উল্লেখ করা যায়। হালকা, মাঝারি ও ভারী কাজ করার জন্য কতটুকু কিলোক্যালরি শক্তির প্রয়োজন হয় তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো। এই তালিকার মধ্যে দৌড়ানো ও খেলাধুলার জন্য শক্তির উল্লেখ রয়েছে।

 

 

প্রতি কিলোগ্রাম দেহের ওজনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় শক্তি ব্যয়ের পরিমাণ-

                                  কাজের ধরন শক্তি (কিলোক্যালরি)
গোসল, পোশাক পরা, খাওয়া ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজ ৩-৪

বসা বা দাঁড়িয়ে থাকা

পায়ে হাঁটা

১.৫-১.৯

৩-৫

মাদ্রাসা-কলেজে পড়াশুনা, লেখা, সেলাই, টাইপ করা, রান্নাবান্না ইত্যাদি ১.৫-২
জুতার কারিগর এর মতো মাঝারি শ্রম
২.৫-৪.৫
কাঠ চেরাই, পাথর ভাঙ্গা, বোঝা বহন করা প্রভৃতি ভারী শ্রমের কাজ
৫-১০
দৌড়ানো ও খেলাধুলা করা ৪-৮


কিলোক্যালরি শক্তি পরিমাপের পদ্ধতি : কোনো কাজ করার জন্য কার কতটুকু শক্তির দরকার তা উপরের তালিকা থেকে নির্ণয় করা যাবে। উদাহরণ স্বরূপ- ৫৫ কেজি ওজনের একজন খেলোয়াড়ের দুই ঘণ্টা খেলার কাজে শক্তি খরচ হবে- ৫৫ কেজি × ২ ঘণ্টা × ৪ কিলোক্যালরি = ৪৪০ কিলোক্যালরি। সুতরাং কাজ করার জন্য কী পরিমাণ শক্তির দরকার তা নির্ভর করে দেহের ওজন ও কাজের ধরনের উপর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি দেহে মেদ বৃদ্ধি করে। একজন পুরুষ ও একজন মহিলার দৈনিক ক্যালরির চাহিদার ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের প্রতি পাউন্ড ওজন ২১ দিয়ে এবং মহিলার প্রতি পাউন্ড ওজন ১৮ দিয়ে গুণ করে যে গুণফল পাওয়া যাবে তাই হবে তাদের ক্যালরির দৈনিক চাহিদা। তবে মনে রাখতে হবে যে দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন তা তিন বেলার আহার থেকে গ্রহণ করা উচিত।

 

বয়স অনুসারে খাদ্য উপাদানের দৈনন্দিন চাহিদা

বয়স শক্তি (কি ক্যালরি) প্রোটিন (গ্রাম) ক্যালসিয়াম ( মি: গ্রাম:)
আয়রন ( মি: গ্রাম:)
ভিটা – এ (মাইক্রোগ্রাম) ভিটা:বি-১ (মি: গ্রাম:   ভিটা:বি-২ (মি: গ্রাম: ভিটা:সি (মি: গ্রাম:)
কিশোর-কিশোরী (১৩-১৫ বছর)
 

২৫০০

২২০০

৫৫

৫০

৬৫০

৬৫০

১৮

২৪

৭২৫

৭২৫

১.৩

১.৩

১.৪

১.৪

৩০

৩০

ছেলে-মেয়ে
(১৬-১৮ বছর)

৩০০০

২২০০

৬০

৫০

৫৫০

৫৫০

২৪

৭৫০

৭৫০

১.৫

১.১

১.৭

১.২

৩০

৩০

প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ২৪০০ ৫৫ ৪৫০ ৭৫০ ১.২৫ ১.৩ ৩০
প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোক ১৯০০ ৫০ ৪৫০ ২৮ ৭৫০ ১.০ ১.০ ৩০

 


বাড়ন্ত ছেলে-মেয়েদের দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ


খাদ্যের মৌলিক শ্রেণি

                       ছেলে
 
            মেয়ে
  ১৩-১৫ বছর
গ্রাম
 

১৬-১৮ বছর

গ্রাম

১৩-১৮ বছর

গ্রাম

দুধ বা দুধজাত খাদ্য

 
১৮৭.৫ ১৮৭.৫ ১৮৭.৫
ডিম (সপ্তাহে ৩ দিন )      
মাছ-মাংস ৬২.৫ ৬২.৫ ৬২.৫
ডাল ৬২.৫ ৬২.৫ ৬২.৫
বাদাম (মাঝে মাঝে ) ৬২.৫ ৬২.৫ ৬২.৫
ফল ৬২.৫ ৬২.৫ ৬২.৫
 সবুজ শাক   ১২৫.০ ১২৫.০ ১৪০.০
অন্যান্য সবজি ১৮৭.৫ ২৫০.০ ১৮৭.৫
ভাত  ১৮৭.৫ ২৫০.০ ১৮৭.৫
 রুটি ১৮৭.৫ ১৮৭.৫ ১২৫.০
আলু ৬২.৫ ৬২.৫ ৬২.৫
চিনি/গুড়  ৩১.২৫ ৪৬.৫ ৩১.২৫
তেল/চর্বি ৪৬.৫ ৬২.৫ ৪৬.৫

 

কাজ-১ : বিভিন্ন প্রকার শারীরিক পরিশ্রমের উপর কী পরিমাণ কিলোক্যালরি শক্তি ব্যয় হয় তার একটি তালিকা তৈরি কর।

কাজ-২ : বাড়ন্ত ছেলে-মেয়েদের দৈনিক খাদ্য চাহিদা একটি ছকে উল্লেখ কর।



 

Content added || updated By

পাঠ- ৪ : খাদ্যে বিষক্রিয়া, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিবিধান :

 আমরা যা খাই তাকেই খাদ্য বলা যায় না। বরং যা খেলে আমাদের শরীরের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধন ও তাপ সংরক্ষণের কাজ সম্পন্ন হয় তাকে খাদ্য বলে। শারীরিক ক্রিয়াকর্মের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। খাদ্য দ্বারা আমাদের শরীরের এই ক্ষয়পূরণ হয় এবং দেহ কর্মক্ষম রাখে। তবে এ সকল খাদ্য হতে হবে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং সুষম। অতিরিক্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যও আবার শরীরের উপকার না করে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। খাদ্য যদি দূষিত হয়ে পড়ে তাহলে দূষিত খাবার খেয়ে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে। দূষিত খাদ্য বিষাক্ত এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করে। যে খাদ্য বা পানীয় খাদ্যনালির ও পাকস্থলীর অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু দ্বারা বিষাক্ত হয় সে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করলে ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়।

কারণ : সাধারণত ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) দ্বারা সংক্রমিত অথবা টক্সিন (Toxin) বা বিশেষ ধরনের জৈববিষ দ্বারা খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ব্যাকটেরিয়া নানাভাবে খাদ্যে প্রবেশ করে। যেমন- খাবার তৈরি করে অনেকক্ষণ রেখে দিলে, খাবার তৈরির আগে, তৈরির সময় এবং পরে, বাজার থেকে সংক্রমিত খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের সময়, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গের সংস্পর্শে বিভিন্নভাবে খাদ্য বিষাক্ত হতে পারে। আবার প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করলে তা পচে গিয়ে টক্সিন বিষ তৈরি হয়। এরূপ পচা খাদ্য গ্রহণ করলে ফুড পয়জনিং হবে। এছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত জীবজন্তুর মাংস এবং জীব-জন্তুর সাথে নির্গত রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত খাদ্য, অপরিষ্কার হাত দিয়ে তৈরি খাদ্য, বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হাঁস-মুরগির মাংস, প্রভৃতিও খাদ্যে বিষক্রিয়ার অন্যতম কারণ।

বিষক্রিয়ার লক্ষণ : ব্যাকটেরিয়াজনিত দূষিত খাবার থেকে পাকস্থলীর অন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়; ফলে বমি বমি ভাব, বমি, তলপেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা এবং পানিশূন্য হয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। আর টক্সিনজাত বিষাক্ত খাদ্য শরীরে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে। বমি, কোষ্ঠবদ্ধতা, দৃষ্টিশক্তির বিকৃতি, স্নায়ুর পক্ষাঘাত, দুর্বলতা প্রভৃতি উপসর্গ প্রকাশ পায়। এ ধরনের ফুড পয়জনিংকে বটিউলিজম বলা হয়। এরূপ বিষক্রিয়ার লক্ষণ খাদ্য গ্রহণের ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পরে দেখা যায়। যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে রোগী কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায় ।

প্রতিবিধান
১। খাদ্য প্রস্তুত করার পূর্বে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
২। সংক্রমণ থেকে খাদ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য খাদ্যের প্রস্তুতি ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩। নিরাপদ দূষণমুক্ত পানি পান করতে হবে।
৪। কাঁচা শাক-সবজি, মাছ-মাংস যাতে রান্না করা খাবারের সংস্পর্শে না থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫। রান্না করা খাবার নির্ধারিত তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। রান্নার কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে।

চিকিৎসা : বমি বমি ভাব বা বমি হলে বমি নিরোধক ঔষধ গ্রহণ করতে হবে। পানিশূন্যতা রোধে মুখে খাওয়ার স্যালাইন ORS- (Oral Rehydration Solution) খেতে হবে। ফুড পয়জনিংয়ের ফলে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে অথবা দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

কাজ-১ : কীভাবে খাদ্যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা ধারাবাহিকভাবে লেখ এবং শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন কর।

কাজ-২ : খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিষাক্ত খাবার খেলে কী কী লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং কীভাবে এর প্রতিবিধান করা যায় তার দুটি তালিকা আলাদাভাবে তৈরি কর।


 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion